শফিকুল ইসলাম সাগর গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধিঃ
এরা সেই আদি যুগের এনালগ শিকারী! আজও পরিবর্তন হয়নি জীবন মান। কিন্তু পুর্ব পুরুষদের সেই দলবদ্ধ ভাবে একত্রিত হয়ে বসবাস করার নিয়মটা এখনো ধরে রেখেছে এই সাঁওতাল সম্প্রদায়। এরা অন্যন্য জাতী,গোত্রের তুলনায় অনেকটাই বেশি একতা বদ্ধ ভাবে বসবাস করে। দেশ স্বাধীনের সময় সাঁওতালরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ এই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তীর ধনুক পরিচালনায় পারদর্শী বেশ কিছু যুবক রংপুর পাক সেনাদের ক্যাম্প আক্রমন করেছিল, যা রংপুরের প্রবেশদ্বার মর্ডান মোড়ে মুক্তিযোদ্ধা ফলকে আজও দৃশ্যমান। তবে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন হলেও উন্নয়ন হয়নি এই সাঁওতাল জনগোষ্টির। এই সম্প্রদায়ের ২২ সদস্যর একটি দলের সাথে দেখা মেলে গত ২৯ আগষ্ট বিকালে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার ধাপেরহাট এলাকায়। এদের বাড়ী রংপুর জেলার পীরগঞ্জ চতরাহাট এলাকার অনন্তপুর গ্রামে। পায়ে হেটে ১৩ কি:মি পথ অতিক্রম করে এসেছে শিকারের সন্ধানে। আবারো শিকারের সন্ধানে চলেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মাঠ থেকে মাঠান্তরে। ঝোঁপ, ঝাড়ে, গ্রামের ছোট,ছোট জঙ্গলের মধ্যে যেখানে রয়েছে শিকারের আনাগোনা, সারাদিন শিকার খুজে পেয়েছে মাত্র ১টি গারোয়া বা বন বিড়াল নামক প্রাণী। যার ওজন হবে ৭/৮ কেজি। এ সদস্যের সবার হাতে দেখা গেছে দেশীয় অস্ত্র, কারো হাতে তীরধনু, কারো হাতে লাঠি,কারো হাতে বলরাম (শুলপি),সাথে আছে দুটি পোষা কুকুর। কথা হয় এ দলের সদস্য রাম্পা, রঘুনাথ, টুডু, আর বিশ্বনাথ মুরমুর সাথে, তাদের ভাষায় বলেন, বাবু, আমাদের আর পোষায় না। আগের মতো,বন জংঙ্গল নেই, তাই শিকারের দেখা পাওয়া যায় না। যদিও দুই একটি কপাল গুনে দেখা মেলে, এতোগুলি লোক নিয়ে তা ধরে পোষায় না। তাই আমরা এখন অনেকেই পরের জমিতে কৃষি কাজ করি। কাজ কর্ম না থাকলে সখের বসে দলবদ্ধ হয়ে শিকারের সন্ধানে বের হই। আর মহিলারা বাঁশ ঝাড়,বন জঙ্গলে মাটির নিচ থেকে আলু তোলে (বিষ আলু) এসব খেয়ে পরেই আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে কোনমতে বেঁচে আছি। তবে বাবু, এখন আমরা কিছু কিছু সরকারী সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি। আমরা এখন ভোটাধিকার পেয়েছি। মেম্বার,চেয়ারম্যান,এমপি নির্বাচনে ভোট দিতে পারি। সবেমিলে বেঁচে আছি। শিকার ধরার কৌশলাদি জানতে চাইলে তারা জানান, আমাদের চোঁখ আর তীরের নিশানা মিছ হয়না। প্রথমে শিকারকে লক্ষ্য করে হাতের তীর ছুড়ে মারি,এতে শিকার গর্তে ঢুকে গেলে সাপল দিয়ে মাঠি খুরে লাঠি দিয়ে আঘাত করে শিকারকে আহত করি। আর যদি শিকার দৌড়ে পালাতে চায়,তাহলে আমাদের সাথে থাকা পোষা কুকুরকে লেলিয়ে দেই। শিকার বলতে,গারোয়া বন বিড়াল,বড় ইদুর,কাঠ বিড়ালি, বেজি, কুচিয়া মাছ,খরগোশ আরও অন্যান্য প্রাণী। তবে মজার একটি বিষয় বর্ণনা করেছেন, এই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সদস্য হেমাংকু তার বক্তব্য মোবাইল যুগ,অনেকে আমাদের ফোন নম্বর নিয়েছে,এখন তারা ফোন করে খবর দেয় তাদের বাড়ীর পাশে বাঁশ,ঝাড়,জঙ্গলে,গারোয়ার উৎপাত বেড়েছে। প্রায়ই গৃহপালিত প্রাণী হাঁস, মুরগী,কবুতর খেয়ে সাবার করছে। আসেন ভাই,মারেন ভাই। তাই বাধ্য হয়েই আমরা ছুটে যাই। বন্যপ্রাণী মারা অন্যায় এমন প্রশ্ন করতেই উত্তর দেয় আমরাতো বড় কোন বন্য প্রাণির ক্ষতি করছিনা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য বা অনেক সময় পেটের দায়েই শিকার করে থাকি। অনুষ্ঠান বলতে ২৫ ডিসেম্বর বড় দিন, বিবাহ অনুষ্ঠানের আগে আমরা বিভিন্ন প্রাণী শিকার করে থাকি। এছাড়াও পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা দলবদ্ধ ভাবে শিকারের সন্ধানে বেড় হই। সারা দিনে একটি মাত্র শিকার,তাও আবার ২২জন মিলে,ভাগ-বাটোয়ারা হবে কেমনে? এমন প্রশ্নের জবাবে বাস্কে মুরমুর বলেন, শিকার বেশি পেলে কেটে মাংশ ভাগ বাটোয়ারা করে নেই,আর দুই একটি হলে একত্রে রান্না করে সবাই মিলে মিশে খাই। তবে এ শিকার ধরার পেছনে আমাদের একটা বিরাট মনের আনন্দ আছে বাবু। বলতে পারেন যা একধরনের নেশা। বর্তমানে সাঁওতাল জনগোষ্টি জীবিকার তাগিদে নারী পুরুষ উভয়েই কৃষিকাজ সহ বিভিন্ন কলকার খানার কাজ বেছে নিয়েছেন। বউ,ছেলে-মেয়ে,দাদা-দাদি সহ যৌথ পরিবারে বসবাস করতে এরা স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। অনেক ইতিহাস,ঐতিহ্যের স্বাক্ষী বহন করে এই সাঁওতাল সম্প্রদায়। সেই এনালগ যুগের শিকারি দল দেশীয় অস্ত্র নিয়ে গ্রামীণ রাস্তায় বেড় হলে অনেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তাদের শিকারের কৌশল দেখতে। এ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোক এখন খুব একটা চোঁখে পড়েনা। দেশ স্বাধীনে যাদের ভুমিকা ছিল সেই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের জীবন মান উন্নয়নের জন্য সরকারের আরও বেশি নজর দারী প্রয়োজন।