বিপুল ইসলাম আকাশ, সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধিঃ
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার নদীবেষ্টিত একটি ভোট কেন্দ্রে বিগত ২০ বছর ধরে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ ভোট হয় না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কেন্দ্র দখল, ব্যালট বক্স ছিনতাই, জাল ভোট প্রদান ও প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে প্রকাশ্যে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ইতোপূর্বে ঘটেছে। এবারে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে এ উপজেলা ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এতে ওই কেন্দ্রে ভোট দেওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ভোটাররা।
উপজেলার সদর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে কাপাসিয়া ইউনিয়নের নদী বেষ্টিত ১নং ওয়ার্ডের ভোট কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা এক সময় ছিল ৪ হাজারের অধিক। নদী ভাঙ্গনের ফলে এই এলাকার ভোটাররা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী জেলাসমুহের বিভিন্ন উপজেলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করায় তারা সেখানকার ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে এ কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১১ জনে। দুর্গম চরে অবস্থিত চর কাপাসিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওই ওয়ার্ডের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয়রা বলছেন, কেন্দ্রটি ব্রহ্মপুত্র নদের ওইপাড়ে হওয়ায় খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি কেন্দ্র। বিগত কয়েকবার থেকে এখানে কোন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়না। এ অঞ্চলের প্রভাবশালী একটি পরিবার বরাবরই ভোট কেন্দ্র দখল করে তারাই বার বার ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছে। ২০০৩ সালের পরবর্তী অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনগুলোতে মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকলেও তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেনা। ২০০৩ সালের পূর্বে এ ওয়ার্ডের মেম্বার পদে কোন ভোট হতোনা। ভোটারদের কোণঠাসা করে একক প্রার্থী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা লায়েক আলী খান মিন্টু সিলেকশনে মেম্বার নির্বাচিত হতেন। অদ্যাবধি ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার হিসেবে লায়েক আলী খান মিন্টুর পরিবারের লোকজন দায়িত্ব পালন করছেন।
ভোটারদের অভিযোগ, সারাদেশের ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও তাদের কেন্দ্রে কখনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হয়নি। তাই ক্ষমতায় পালাবদলও হয়নি। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধা লায়েক আলী খান মিন্টু নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। তখন তার বড়ভাবী মেম্বার পদে নির্বাচন করেন। তারা ভোট কেন্দ্র দখল করে প্রতিদ্বন্দ্বী মেম্বার প্রার্থী ইক্তিয়ার হোসেন বিপুলের এজেন্টদের বের করে দিয়ে এককভাবে সিল মেরে নেয়। আসন্ন ২৮ নভেম্বরের নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধা লায়েক আলী খান মিন্টুর স্ত্রী খুরশিদ জাহান আক্তার মেম্বার প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এবারেও ভোট কেন্দ্রে তাদের দখলে নিতে বাঁশ, লাঠি-শোটা কেন্দ্রের পাশে একত্রিত করছে। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ইক্তিয়ার হোসেন বিপুলসহ ভোটাররা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট নিয়ে সঙ্কায় রয়েছে।
ভোটার খয়বার হোসেন (৫২) বলেন, ‘আমি কখনো এই কেন্দ্রে ভোট দিতে পারিনি। লায়েক আলী খান মিন্টু কেন্দ্র দখল করে ভোট মেরে নেয়। কেন্দ্রটি দূর্গম এলাকায় হওয়ায় তারা প্রতিবারই জাল ভোট মেরে মেম্বার নির্বাচিত হয়।’
অপর আরেক ভোটার আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমি কখনো এখানে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট দেখিনি। এবার আমরা আশায় বুক বেধে আছি ভোটের দিন কেন্দ্রে গিয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থায় ভোট দিব।’
মমিনুল ইসলাম (৩২) নামের একজন ভোটার বলেন, ‘২০১৬ সালের নির্বাচনে আমাদেরকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। লায়েক আলী মিন্টুর লোকজন কেন্দ্র দখল করে ভোট মেরে নেয়। তারা কখনো এই কেন্দ্রে সুষ্ঠুভাবে ভোট করতে দেয়নি। আশা রাখি এবার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাহলে আগ্রহ নিয়ে ভোট দিয়ে পারবো।’
শাহানাজ আরা শিল্পী (৩৫) নামের একজন নারী ভোটার বলেন, ‘বিগত ইউপি নির্বাচনে আমি মেম্বার প্রার্থী ইক্তিয়ার হোসেন বিপুলের এজেন্ট ছিলাম। আমাকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তারা কেন্দ্র দখন করে সিল মেরে মেম্বার নির্বাচিত হয়েছে। এবার আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে চাই।’
মেম্বার প্রার্থী ইক্তিয়ার হোসেন বিপুল বলেন, ‘আমি ১৫ বছর ধরে নির্বাচন করে আসছি। প্রভাবশালী লায়েক আলী খান মিন্টু আমাদের ভোটাধিকার হরণ করে বার বার নির্বাচিত হয়ে আসছে। আমি এবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ওসি, নির্বাচন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। যাতে ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অনুষ্ঠিত হয়। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া এখানে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব না। তাই প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
অপর মেম্বার প্রার্থী ও লায়েক আলী খান মিন্টুর স্ত্রী খুরশিদ জাহান আক্তার বলেন, ‘১নং ওয়ার্ডে বরাবরই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য থাকায় ভোটারগন আমাদেরকেই নির্বাচিত করে আসছে। বিগত ২০১৬ সালের নির্বাচনে তারা আমার বড় জাকে মেম্বার নির্বাচিত করেছিল। এবার আমি নির্বাচনে অংশগ্রহন করেছি। আমাদের কেন্দ্র কোন ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হয়। আমাদের প্রতিপক্ষের জনপ্রিয় না থাকায় বার বার হেরে গিয়ে এসব অপবাদ দিচ্ছে। আমি আশাবাদী জনগণ এবার আমাকে নির্বাচিত করবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভোটাররা বিভিন্ন এলাকা থেকে আসবে। তাই নারী ভোটারদের নিরাপত্তার জন্য আমরা অস্থায়ী তাবু করে সেখানে রাখবো। সেজন্য আমরা বাঁশ আর কাঠ সেখানে নিয়ে গিয়েছি। দাঙ্গা-হাঙ্গামা করার জন্য নয়।’
উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ও ইউপি নির্বাচনে নিয়োজিত রিটার্নিং কর্মকর্তা ফজলুল করিম বলেন, ‘ওই কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আমরা বদ্ধপরিকর।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাঁশ আর কাঠ অপসারণের জন্য আমি ইউএনও স্যারকে বলেছি। শীঘ্রই ওগুলো অপসারণ করা হবে।’