মোঃ ওবায়েদুর রহমান সাইদ শরীয়তপুর সদরঃ

মোঃ সিয়াম খান শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বিঝারী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। দুই ভাইয়ের মধ্যে সিয়াম ছোট। বাবা মায়ের খুব আদরের সন্তান সিয়াম। সিয়াম এবার ঢাকা বোর্ডের অধীনে এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই নামাজের প্রতি সিয়ামের ছিলো অগাধ ভক্তি। গত বছরের ৫ এপ্রিল মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে আসার সময় ঝড়ে পল্লী বিদ্যুতের ছিঁড়ে পড়া তারে জড়িয়ে দুই হাতের কনুই পর্যন্ত হারায়। পল্লী বিদ্যুতের অবহেলার শিকার হয়ে তাঁর দুটি হাত পুড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কর্তব্যরত ডাঃ তার দুটি হাত কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। সিয়ামের এই ঘটনা সারা বাংলাদেশের মিডিয়াকে তোলপাড় করে তুলে। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও নিউজ পেপারে এ নিয়ে নিউজ হতে থাকে। এতে পল্লী বিদ্যুতের গাফিলতির কথা তুলে ধরা হয়। উল্লেখ্য যে সিয়াম যখন মসজিদে নামাজ পড়তে যায় তখন বিদ্যুতের 420 Volt লাইনের তার খুঁলে পড়েছিল মাটিতে। তখন সিয়াম তার ব্যবহৃত মোবাইল থেকে পল্লী বিদ্যুতে ফোন করে বিষয়টি তাদের অবহিত করে। কিন্তু পল্লী বিদ্যুৎ তা কর্ণপাত না করে লাইন ঠিক না করেই কিছুক্ষণ পরে ঐখানে বিদ্যুতের লাইন সংযোগ দেন। এতে করে নামাজ শেষে ঐ স্থান দিয়ে সিয়াম আসার সময় বিদ্যুতের ছিঁড়ে পড়া তারে জড়িয়ে পড়েন। সিয়াম ভেবেছিল তার ফোন পেয়ে হয়তো পল্লী বিদ্যুতের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরা তা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু পল্লী বিদ্যুতের লোকেরা তা করেনি। তাছাড়া সিয়াম বৈদ্যুতিক তারের অনেক দূর দিয়েই যেতে ছিলে ঠিক ঐ সময় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ায় বৈদ্যুতিক লাইনের তার ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে বৈদ্যুতিক তার এসে সিয়ামকে জড়িয়ে ফেলে। এতে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ পুঁড়ে যায়। কিছুদিন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসার পর তার চিকিৎসকরা তাঁর হাত দু’টো কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলে। নতুবা তাঁর পুরো শরীরে ঘাঁ ছড়িয়ে পড়তো। হাত হারিয়ে সিয়াম বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু এতে দমে যায়নি সিয়াম। সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে শুরু হয় তাঁর স্বপ্ন জয়ের লড়াই। সকল বাধা দূর করে সিয়াম নড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে অংশ নিয়েছে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায়। কলেজ কর্তৃপক্ষ সিয়ামের লেখায় সহযোগিতা করার জন্য একজন ‘রাইটার’ দিয়েছিল। তবুও নিজের হাতে লেখা অন্যের সাহায্য নিয়ে লেখার মধ্যে বিস্তর তফাৎ।

সিয়ামের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় আমার কোচিং এ। এর আগে অবশ্য সিয়াম সম্পর্কে জেনেছি। একদিন সকালে এরফান, আলতাফ ও নাহিদের ওদের সাথে এসে সিয়াম আমার সাথে দেখা করে সিয়াম এবং আমার কাছে বলে স্যার আমাকে পড়াবেন? আমি সিয়ামকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই, ওকে প্রথম দেখে আমার অনেক খারাপ লাগে!!! এতো সুন্দর একটি ছেলে অথচ তার দু’টি হাত নেই, ভাবতেই আমার হৃদয়টা কেঁপে উঠে। সেদিনের পর থেকে সিয়াম আমার কাছে পড়তো। কোন কিছু বুঝালে খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টা ধরতে পারতো। একদিন একটা সার্কিট এঁকে দেখাচ্ছি এবং এর সাথে কিছু বুলিয়ান ফাংশন, তখন সিয়াম বলে উঠে স্যার আমি একটা ফাংশন বোর্ডে করি? শুনে আমি চমকিয়ে উঠি!!! তারপরে বলি ওকে কর। তারপর সিয়াম তার কাঁটা দু’হাত দিয়ে কোনরকমে মার্কার ধরে বোর্ডে লেখা শুরু করে। লেখা দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে ঐটা ওর লেখা। সিয়াম সবার সাথে খুব ভালোভাবে মিশে গেলো। আমার প্রতিটি ব্যাচের সাথে সিয়াম সময় দিতো এবং সবার সাথে তার সম্পর্ক ছিল দারুণ।

সিয়ামের সাথে নড়িয়া কেন্দ্রে পরীক্ষা শেষে প্রায়শই দেখা হ’ত ও কথা হ’ত পরীক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে। পরীক্ষার আগে যখন সময় পেতাম ওর সাথে দেখা করতাম। নিজের লেখা আর বলে বলে লেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে, তারপরেও আশা রাখি সিয়াম পরীক্ষায় ভালো করবে।

দু’হাত ছাড়া একজন মানুষের যে কি কষ্ট এটা ভুক্তভোগী যে সেই অনুভব করতে পারে। হাত ছাড়া একটা মানুষকে সীমাহীন কষ্ট ভোগ করতে হয়। সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয় অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। সিয়ামকে আল্লাহ্‌ ভালো রাখুক।

সিয়ামের সার্বিক অবস্থা শুনে জননেতা ও আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় Md Sultan Mahmud সীমন স্যার সিয়ামের পাশে এসে দাঁড়ায়। নিজের মনে করে সিয়ামের হয়ে পল্লী বিদ্যুতের সাথে লড়ে। তার একমাত্র ব্যারিস্টার ছেলেকে বাদী করে হাইকোর্টে পল্লী বিদ্যুতের বিরুদ্ধে মামলা করেন। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সিয়ামের জন্যে লড়ে যান। অবশেষে তার ছেলের জয় হয়। হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারক মন্ডলীগণ সিয়ামের পক্ষে রায় দিয়ে পল্লী বিদ্যুতকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দেন। যাতে করে বিদেশে গিয়ে কৃত্রিম হাত লাগিয়ে বাকি জীবনটা একটু ভালোভাবে কাটাতে পারে। মামলা চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী লোক দিয়ে পল্লী বিদ্যুতের লোকজন সীমন স্যারকে মামলা থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্যে বলে। কিন্তু অন্যায়ের কাছে আপসহীন এই ত্যাগী নেতা তা করেননি। সকল ভয়ভীতি ও সুপারিশকে অগ্রাহ্য করে সিয়ামের জন্যে লড়ে যান। আমার পক্ষ থেকে স্যারের প্রতি রইল অসংখ্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

হাইকোর্ট থেকে পল্লী বিদ্যুৎকে ৫০ লাখ টাকা দিতে বললেও এখনো কোনো টাকা পাইনি সিয়ামের পরিবার। এমনকি সিয়ামের চিকিৎসা চলাকালীন কোন সহায়তাও করেনি পল্লী বিদ্যুৎ।

আদালতের সেই আদেশের পর তা আবার আপিল হয়। জানিনা কবে নাগাদ এই আপিলের সুরাহা হবে। প্রার্থনা করি যেন তাড়াতাড়ি আপিলের রায় হয় এবং পূর্বের রায় যেন বহাল থাকে। সীমন স্যার এ ব্যাপারটা নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যেন সফল হোন এই প্রত্যাশা রইল।