মোঃ ইসমাঈল হোসেন, বগুড়া সদর প্রতিনিধিঃ

বগুড়া বিহারহাটের আশপাশের গাছগুলোতে হাজারো পাখির আবাসস্থল। মাথার ওপর উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। কিচিরমিচির ডাকে মুখর চারদিক। পাশেই বহু বছরের পুরোনো পাকুড়গাছ। ডালে ডালে ঝুলছে পাখির বাসা। ছোট ছানাগুলো বাসার ভেতরেই বসে আছে চুপচাপ। তারা মাঝেমধ্যে মাথা উঁচু করে উঁকিঝুঁকি দেয় আর ডানা ঝাঁপটায়। ফসলের মাঠ ও খাল-বিল থেকে ঠোঁটে খাবার নিয়ে উড়ে এসে ডালে বসে মা পাখি। পরম যত্নে তা ছানার মুখে তুলে দেয়। খাবার পেয়ে ছানাগুলো ডানা ঝাঁপটায় ও খুনসুটিতে মেতে ওঠে।

ডানা মেলে ওড়াউড়ির চেষ্টা করতে গিয়ে ডাল ভেঙে ধপাস করে মাটিতে আছড়ে পড়ল পাখির দু-তিনটি ছানা। গাছের নিচে খেলা করা দুরন্ত শিশুদের দল পাখির ছানাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে দেয় ভোঁ–দৌড়। শিশুরা পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে থামে। সেখানে দুই তরুণ ছানাগুলো নিয়ে একটি ভবনের ছাদে উঠে মা পাখির বাসায় যত্ন করে রেখে দিয়ে আসেন। সম্প্রতি এক সকালে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার হাট এলাকায় পাখি আর মানুষের এমন মিতালির দৃশ্য দেখা যায়।
বিহার হাটখোলায় দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো কয়েকটি পাকুড়গাছ। স্থানীয়দের ভাষ্য, এসব পাকুড়গাছ শতবর্ষী। ৮-৯টি পাকুড়গাছে বাসা বেঁধেছে ঝাঁকে ঝাঁকে শামুকখোল পাখি। বিহার গ্রামবাসীর সঙ্গে ভিন্ন রকম ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে পাখিদের।
বিহার গ্রামের আবদুল আজিজ বলেন, বিহার হাট ও আশপাশে প্রায় ২০ হাজার মানুষের সঙ্গে অন্য রকম মিতালি গড়ে উঠেছে পাখিগুলোর। শিকারি ও উৎপাতকারীদের ঠেকিয়ে পাখিদের আগলে রাখেন স্থানীয় লোকজন।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, প্রতিবছর চৈত্র-বৈশাখে ঝাঁকে ঝাঁকে শামুকখোল পাখি উড়ে এসে হাটখোলায় শতবর্ষী পাকুড়গাছের ডালে বাসা বাঁধে। ফসলের মাঠ, খাল ও বিল থেকে তারা খাবার সংগ্রহ করে। বাসায় বাসায় ডিম দেয়, বাচ্চা ফুটায়। প্রজনন শেষে পরম মমতায় পাখি ছানা বড় করে তোলে। ছানাগুলোকে ওড়াউড়ি শেখায়। কার্তিক মাসের শেষের দিকে শীতের আগেই অতিথি পাখিরা দূর অজানায় উড়ে যায়। বৈশাখ থেকে কার্তিক—এই সাত মাস হাজারো শামুকখোল পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে বিহার হাটখোলা ও আশপাশের এলাকা।
বিহার গ্রামে পাখি, প্রাণী, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে সরকারি আজিজুল হক কলেজ ক্যাম্পাসভিত্তিক সংগঠন ‘তীর’ (টিম ফর এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ)। এক যুগ আগে বিহার গ্রামকে ‘নিরাপদ পাখির রাজ্য’ ঘোষণা করে সংগঠনটি।
একসময় হাটের জায়গায় থাকা পাকুড়গাছের ডালপালা কেটে উজাড় করতেন প্রভাবশালীরা। আশ্রয় হারাত পাখিরা। এখন সেসব দৃশ্য পাল্টেছে। কেউ পাখি শিকার করতে এলে ছুটে আসেন স্বেচ্ছাসেবীরা। প্রতিবাদ জানান এলাকার মানুষ। প্রশাসনের কাছেও খবর চলে যায়। কারাদণ্ড ও জরিমানও করা হয়। এতে বিহার গ্রামবাসীর মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। সেই সঙ্গে পাখি ও প্রাণীর প্রতি তাঁদের তৈরি হয়েছে অন্য রকম মমতা। বিহার হাটে পাখির কলতান দেখতে প্রতিদিন ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। তাঁরা মুঠোফোনে ছবি তোলেন। কেউবা করেন ভিডিও ধারণ।
শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রউফ বলেন, বিহার হাটে শতবর্ষী গাছের ডালে ডালে গড়ে ওঠা পাখির নিরাপদ রাজ্যে শিকারিদের তৎপরতা নিষিদ্ধ। পাখিশিকারির তৎপরতা দেখলেই তাঁকে আটকের জন্য বিহার ইউনিয়নের বিট পুলিশের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া আছে।
শুরুর দিকে পাখি রক্ষায় কাজ করতেন তীরের সদস্যরা। এখন পুরো গ্রামবাসীই যেন স্বেচ্ছাসেবক হয়ে গেছেন। পাখিপ্রেমে মজেছেন সবাই।আবদুর রাজ্জাক, ‘তীর’–এর উপদেষ্টা
বিহার মণ্ডলপাড়ার ষাটোর্ধ্ব কৃষক ভোলা মিয়া বলেন, বিহার গ্রামে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াব মোহাম্মদ আলীর কাচারিবাড়ি, নওয়াবদের স্থাপিত জামে মসজিদ, সাত আনী জমিদারদের কাচারিবাড়ি, সাত আনী মসজিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ভাসুবিহার, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রথম শহীদ বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকির পৈত্রিকভিটা আছে। তবে সব ছাপিয়ে বিহারের পরিচিতি এখন ‘পাখির নিরাপদ রাজ্য’ হিসেবে।
বিহার হাটের মনিহারি দোকানি আবদুল আজিজ বলেন, ‘ম্যালা দিন হচ্চে, হাটের শতবর্ষী এই সব পাকুড়গাছত অতিথি পাখি আসিচ্চে, বাসা বাঁন্ধিচ্চে। বৈশাখ মাসত পাখি আসিচ্চে, ডিম ফুটাচ্চে, বাচ্চা দিচ্চে। পাখি ছানা ওড়াউড়ির ট্রেনিং দিচ্চে, আশ্বিন মাসত চলেও যাচ্চে।’
তীর–এর উপদেষ্টা আবদুর রাজ্জাক বলেন, শুরুর দিকে পাখি রক্ষায় কাজ করতেন তীরের সদস্যরা। এখন পুরো গ্রামবাসীই যেন স্বেচ্ছাসেবক হয়ে গেছেন। পাখিপ্রেমে মজেছেন সবাই।
তীরের বিহার আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র মাসুদ রানা। তিনি বলেন, শিকারিদের উৎপাত বন্ধ করতে এবং পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করতে সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে তীরের সদস্যরা পাখি রক্ষায় সচেতনতামূলক নানা সভা, সমাবেশ, প্রচারপত্র বিলি, ডিজিটাল ব্যানার স্থাপনসহ নানা কার্যক্রম শুরু করেন। পরে বিহার গ্রামকে পাখির নিরাপদ রাজ্য গড়ে তুলতে ২০১৩ সালে তীরের আঞ্চলিক কমিটি করা হয়। প্রথমে স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ছিল ৩০। এখন গ্রামের ২০ হাজার মানুষই পাখি রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।