ওয়াসিম শেখ, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
কালের বিবর্তনে দেশের গ্রামাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এক কালের কৃষক-কিষানির ধান ভাঙ্গার প্রধান যন্ত্র ঢেঁকি। অতীতে গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে চাল তৈরির জন্য কিংবা চালের গুঁড়ি তৈরির জন্য একমাত্র ঢেঁকিই ছিল ভরসা। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির কাছে ম্লান হয়ে গেছ সেই আগের দিনের ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকির ব্যবহার। ৮০-৯০ দশকে ভোরের আজানের পাশাপাশি স্তব্ধতা ভেঙে ঢেঁকির শব্দ ছড়িয়ে পড়ত গাঁও গ্রামের চারদিকে। এখন সেই শব্দ নেই। চোখে পড়ে না বিয়ে শাদির উৎসবের ঢেঁকি ছাঁটা চালের ফিরনি-পায়েস। যেখানে বসতি সেখানেই ঢেঁকি। কিন্তু আজ তা আমাদের আবহমান গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনও মাঝে মধ্যে গ্রামীণ জনপদে কিছু উৎসব-পার্বণে ধান থেকে আতপ চাল তৈরি করতে পিঠা বানাতে, চালের গুঁড়ি তৈরি করতে গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ ঘরে পুরনো ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দ শোনা যায়। আত্মীয়স্বজন একসঙ্গে ঢেঁকিতে বারা ভেনে যে আনন্দ পেয়ে থাকে তা কলে ছাঁটায় পাওয়া কখনও সম্ভব নয়। এখন শিক্ষার প্রসার গ্রামেও কমবেশি হয়েছে। ঢেঁকিতে বারা ভানা প্রায় ভুলেই গেছে। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া বৃদ্ধা বা বয়স্ক মহিলারা গর্ব করে বলত এই ঢেঁকি আমার দাদাশ্বশুরের আমলের। ভাদ্র মাসে আউস ও অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে রোপা আমন ধান ঘরে উঠলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নানা রকম পিঠা ও পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যেত। আর এজন্য বাড়িতে বাড়িতে আটা কোটার ধুম পড়ে যেত। দু’জন মহিলা সারাক্ষণ ঢেঁকিতে পাড় দিত আর একজন ধানগুলোকে উনুতে (ভাঙ্গার গর্তে) এগিয়ে দিত। এভাবেই সারা রাত ধরে গ্রামের গৃহবধূরা তাদের সারা বছরের চাল ঢেঁকিতে ছেঁটে মাটির কুঠি কিংবা বাঁশের তৈরি ডোলে ভরে সংরক্ষণ করে রাখত। সে সময় ঢেঁকি ছাঁটা চালের ভাত খেয়ে অধিকাংশ মানুষই যেমন তৃপ্তি পেত, তেমনি সুস্থ জীবনযাপন করত।
বর্তমানে আধুনিক যুগে চাকচিক্যের আধিক্যে হারিয়ে গেছে সেই ঢেঁকি ছাঁটা চাল। এখন পাড়ায় পাড়ায় ধান ভাঙ্গা হাসকিং মিল এমনকি ভ্রাম্যমাণ মিল প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান ভেঙে দেয়ায় ঝকঝকে চাল, খাটুনি কম ও সময় সাশ্রয় হওয়ায় সেকেলের ঢেঁকি আর কোথাও চোখে পড়ে না।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চর কল‌্যানী গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ঢেঁকি পাতানো আছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন ঢেঁকির মালিকের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, মেশিনের তৈরি আটা দিয়ে সকল প্রকার খাবার বিশেষ করে পিঠা তৈরি হয় না। তাই অনেক সময় অনেক কিছু খাবার জিনিস তৈরি করতে হলে এখনও ঢেঁকির তৈরি আটা লাগে। বছরে অন্তত দু’এক বার তারা ও পাড়ার অনেকেই এই ঢেঁকিতে এসে আটা তৈরি করে থাকে। তবে আগেকার দিনের মতো ঢেঁকির আর কদর নেই। কোন দিন হয়ত তারাও ঢেঁকিটি তুলে ফেলবেন। বর্তমান যুগে কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকির হয়তো আর দেখাই মিলবে না। আর কিছুদিন পরে নতুন প্রজন্ম হয়ত ঢেঁকির কথা শুনলে সেটি কি জিনিস, তা বুঝানো মুশকিল হয়ে পড়বে।