নুর হোসেন- মিরসরাই উপজেলা প্রতিনিধিঃ
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার শামছুন নেহার পাঁচ বছর আগেও ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালাতেন। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে যা পেতেন তা দিয়ে সংসারের খরচ চালাতেন। তবে তিনি এখন আর ভিক্ষা করেন না। নিজেকে সম্মানিত করতে শুরু করেছেন ব্যবসা।জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের গেড়ামারা গ্রামের পাহাড়ী দিনমজুর বাবার চতুর্থ সন্তান শামছুন নেহার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১২ জুন। অভাবের সংসারে বাবার মৃত্যুর পর জীবন-যাপন শুরু হয় আরো মানবেতর। শুরু হয় জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়ের। পরিবারের চাপে ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় দিনমজুর আলী মিয়ার সাথে। আলী মিয়া পাহাড় থেকে কাঠ কেটে এনে বাজারে বিক্রয় করে সংসার চালাতেন। এক মেয়ে ও তিন ছেলে মিলে ছয়জনের ভরণপোষণ আলী মিয়ার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল।
মেয়ের বিয়ের বয়স হওয়াতে মাথা গুজার একমাত্র অবলম্বন ঘরের ভিটা বন্ধক রেখে বিয়ে দেন মেয়েকে। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় শুরু হয় তার চিকিৎসা খরচ। শুরু হয় অনাহারে ও অর্ধাহারে দিন কাটানোর জীবন। ক্ষুধার জ্বালায় অন্যের বাড়িতে কাজ করেও যেন শান্তি নেই। এক বেলা খেতে দিলে অন্য বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। পেটের ক্ষুধার তাড়নায় হাত পাততে বাধ্য হন মানুষের কাছে। ভিক্ষাবৃত্তি নামের অভিশপ্ত জীবনের সূচনা হয় শামসুন নেহারের।বন্ধকের টাকা পরিশোধ করার আগেই শামসুন নেহারের স্বামীর মৃত্যু হয়। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির চাহিদা মতো যৌতুক দিতে না পারায় মেয়েকে পাঠিয়ে দেয় বাপের বাড়ি।ভিক্ষা করা অবস্থায় কাটাগাং গ্রামে বেসরকারী সংস্থা ‘অপকা’-এর কর্মকর্তা মো: শফির (শিক্ষা সুপারভাইজার) সাথে দেখা হয় শামসুন নেহারের। অপকার পলিকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সমৃদ্ধি কর্মসূচির আওতায় এক লাখ টাকার অনুদান পাওয়ার সুযোগ হয় শামসুন নেহারের। এরপরই যেন বদলে যায় শামছুন নেহারের জীবনের গল্প।
শামছুন নেহার বলেন, ‘আমার স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমি ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করি। স্বামীর চিকিৎসা, তিন ছেলে ও এক মেয়েকে পড়ালেখা করিয়েছি। কোনো মতে সংসার চলতো। এভাবেই একদিন ভিক্ষা করতে গিয়ে ভালুকিয়া এলাকায় অপকার একজন স্যারের সাথে আমার দেখা হয়। তখন স্যার আমার স্বামী ও ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন। আমি সবকিছু বলি এবং এটাও বলি যে আমার ভিক্ষা করতে কষ্ট হয়। তবুও পেটের দায়ে করতে হয়। যদি আপনারা আমাকে একটু সহযোগিতা করেন তাহলে আমি আর ভিক্ষা করবো না।’তিনি আরো বলেন, তার কিছুদিন পর অপকার স্যার আমাকে এক লাখ টাকা দিয়েছেন। এর মধ্যে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে দুটি গরু কিনে দিয়েছেন। বাকি ৫০ হাজার টাকার ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটি দোকান ঘর করে দিয়েছেন। বাকি ৩০ হাজার টাকা ১৫ হাজার করে দু’ভাগে আমার দোকানের জিনিসপত্র তুলে দিয়েছেন। এখন দোকানে প্রতিদিন সাত শ’ থেকে আট শ’ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আমার ছেলে বেলালকে একটা গরু বিক্রি করে বিদেশে পাঠিয়েছি। আরেকটি গরু বিক্রি করে নাতিনের বিয়ের জন্য দিয়েছি। অপকার কারণে আমি এখন ভালো আছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দোকানের আয় দিয়ে ক্রয় করা দু’শতক বসবাসযোগ্য জমি, চারটি গৃহপালিত পশু ও ব্যাংকে জমানো নগদ টাকা। অর্থনৈতিক ভাবে বর্তমানে তার সম্পদের মূল্য প্রায় তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
অপকার নির্বাহী পরিচালক মো: আলমগীর বলেন, ‘ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে শামছুন নেহার এখন ব্যবসা করছেন।’
করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন বলেন, ‘২০১৭ সালে আমিসহ অপকার পক্ষ থেকে শামছুন নেহারের হাতে এক লাখ টাকা তুলে দিয়েছি। তখন থেকে পাল্টে গেছে তার জীবনচিত্র। এখন উনি সমাজের অন্যদের মতো স্বাবলম্বী নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।’