ওয়াসিম শেখ, সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধিঃ

আমাদের শিশুবেলায় আনন্দ-হল্লার একটা উপকরণ ছিল এই কস্তুরি। কস্তুরির স্তুপ করে নৌকার বিকল্প হিসেবে পুকুরে কিংবা নদীতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতাম।
কস্তুরির আভিধানিক নাম কচুরি-পানা [kacuri-pānā] বি. অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এমন জলজ উদ্ভিদবিশেষ, water-hyacinth. Pontederiaceae পরিবারভূক্ত।
আমাদের অঞ্চলে ‘কস্তুরি’ নামকরণ কেন হলো বলতে পারি না। যদ্দুর জানি, বিশেষ জাতের পুরুষ হরিণের তলপেটে জন্মানো থলের মধ্যে থাকা একধরনের সুগন্ধি দ্রব্যকেই কস্তুরী বলে। এই হরিণের নাম কস্তুরী মৃগ। সাধারণত পাহাড়ি এলাকার হরিণের মধ্যেই কস্তুরী পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআনের সূরা মুতাফ্ফিফীন-এ কস্তুরির উল্লেখ রয়েছে। ”কস্তুরী” হচ্ছে মৃগনাভি যা প্রাচ্যে মহামূল্যবান সুগন্ধিরূপে পরিচিত। সেই কস্তুরির নামের সাথে সাযুজ্য রেখে কচুরিপানার আঞ্চলিক নাম কস্তুরি রাখার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। তবে কি কচুরিপানার ফুলের সৌন্দর্যের সাথে মৃগনাভী বা কস্তুরির মিল খুঁজে পেয়েছেন এ অঞ্চলের পূর্বপুরুষরা?
উইকিপিডিয়ায় কস্তুরি বা কচুরিপানা সম্পর্কে লেখা হয়েছে, কচুরিপানা সাতটি প্রজাতি আছে এবং এরা মিলে আইকরনিয়া গণটি গঠন করেছে। কচুরিপানা মুক্তভাবে ভাসমান বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। এর আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকা। পুরু, চকচকে এবং ডিম্বাকৃতির পাতাবিশিষ্ট কচুরিপানা পানির উপরিপৃষ্ঠের ওপর ১ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর কান্ড থেকে দীর্ঘ, তন্তুময়, বহুধাবিভক্ত মূল বের হয়, যার রং বেগুনি-কালো। একটি পুষ্পবৃন্ত থেকে ৮-১৫ টি আকর্ষণীয় ৬ পাঁপড়ি বিশিষ্ট ফুলের থোকা তৈরি হয়।
kochury-pana-4 কচুরিপানা খুবই দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। এটি প্রচুর পরিমাণে বীজ তৈরি করে যা ৩০ বছর পরও অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারে। সবচেয়ে পরিচিত কচুরিপানা Eichhornia crassipes রাতারাতি বংশবৃদ্ধি করে এবং প্রায় দু’ সপ্তাহে দ্বিগুণ হয়ে যায়। কচুরিপানা দক্ষিণ পাকিস্তানের সিন্ধের প্রাদেশিক ফুল।
ধারণা করা হয়, কচুরিপানার অর্কিড-সদৃশ ফুলের সৌন্দর্য্যপ্রেমিক এক ব্রাজিলীয় পর্যটক ১৮শ’ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলায় কচুরিপানা নিয়ে আসেন। তারপর তা এত দ্রুত বাড়তে থাকে যে ১৯২০ সালের মধ্যে বাংলার প্রায় প্রতিটি জলাশয় কচুরিপানায় ভরে যায়। নদ-নদীতে চলাচল দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে আর জলাভূমির ফসল আমন ধান আর পাট চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে, ফলে বাংলার অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেয়।
এমত পরিস্থিতিতে সরকার কচুরিপানার দৌরাত্ব হ্রাসে বাংলার জলাভূমি আইন, বাংলার মিউনিসিপ্যালিটি আইন, বাংলার স্থানীয় সরকার আইন এবং বাংলার স্থানীয় গ্রাম সরকার আইন সংশোধন করে। ১৯৩৬ সালে কচুরিপানা আইন জারি করা হয়, যার মাধ্যমে বাড়ির আশেপাশে কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কচুরিপানা পরিষ্কার অভিযানে অংশ নেয়াকে নাগরিক কর্তব্য ঘোষণা করা হয়। আক্রান্ত এলাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে কচুরিপানা দমনে কার্যকর অভিযান চালতে আদিষ্ট হন।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে সবগুলো দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানার অভিশাপ-মুক্ত করার অংগীকার ছিল। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক নির্বাচনে বিজয় লাভ করে তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং কচুরিপানার বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান চালান। কচুরিপানার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের সাফল্য লাভের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল সার হিসেবে পঁচানো কচুরিপানার উৎকৃষ্টতা। এই গুণের কারণে ভূমিহীন কৃষকরা কচুরিপানা জমিয়ে ভাসমান কৃষিজমি তৈরি করতে শুরু করে। অবশেষে ১৯৪৭ এর মধ্যে বাংলার জলাশয়গুলো কচুরিপানা-বদ্ধতা থেকে মুক্তি লাভে সক্ষম হয়। তবে এখনও বাংলার জলাশয়ে কচুরিপানা বহাল তবিয়তেই আছে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কচুরিপানার ভূমিকা অপরিসীkochury-pana-2ম। মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের থেকে জীবন বাঁচাতে নদীতে, পুকুরে, ডোবায় কচুরিপানার আশ্রয়ে ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা মাথায় কচুরিপানা দিয়ে নদী পার হয়েছে। গাজীপুরের কালিগঞ্জের রাবেয়ার কথা আমরা অনেকেই জানি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘ নয় মাস দেশের ভেতরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র আনা-নেওয়া এবং ছদ্মবেশে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তিনি৷ পাক সেনাদের কবল থেকে বাঁচতে কচুরি পানা মাথায় দিয়ে নদীতে বসে থেকেছেন৷ উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন রাবেয়া৷ তবে এই অল্প বয়সেই নারী নেত্রী ফোরকান বেগম এবং তাঁর মা মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগমের সাহচর্য এবং উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করেন৷ রাবেয়া এবং তাঁর সঙ্গীরা বিডিআর এর এক কমকর্তার কাছে স্থানীয়ভাবে গোয়েন্দাগিরি এবং প্রাথমিক নিরাপত্তার উপর প্রশিক্ষণ নেন৷ তিনি যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অস্ত্র বহন করেছেন৷ ছদ্মবেশে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন৷
যাই হোক, কচুরিপানাকে আমরা যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি না কেন, এর নানা গুণ রয়েছে। আমাদের দেশে গোখাদ্য এবং ফসলি জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার হলেও উন্নত বিশ্বে কচুরিপানার ফুল থেকে অষুধ তৈরি করে থাকে। In Kedah (Java), the flowers are used for medicating the skin of horses, The species is a “tonic। এছাড়াও পূর্ব আফ্রিকায় কচুরিপানা থেকে ঘরের আসবাব, হেন্ডব্যাগ ও দড়ি ও এক ধরনের কাগজ তৈরি করে থাকে। ইদানিং বরিশালে কচুরিপানা থেকে তৈরি হচ্ছে উপহার সামগ্রীসহ নানা পণ্য৷ এগুলো বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে৷
ঘ্রাণ না থাকলেও কচুরিপানার ফুল নান্দনিক ও শিল্পশোভন একটি ফুল। এই ফুলের সৌন্দর্য শিশু-বুড়ো সকলকে মুগ্ধ করে।